অপারেশন জ্যাকপট ১৯৭১, দেশপ্রেম, সাহস ও বীরত্বের গল্প

1135
অপারেশন জ্যাকপট
অপারেশন জ্যাকপট এ আক্রান্ত জাহাজ

ফিচার ডেস্ক: ফ্রান্স, স্পেন, রোম, জেনেভা হয়ে ভারত! মাতৃভূমির ডাকে পালিয়ে এসেছেন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কর্মরত ৮ জন বাঙালি। সেই সাথে অকপটে পাল্টাতে শুরু করেছিল ইতিহাস। সেদিনের এই সাহসী মানুষগুলোর হাত ধরে সময়ক্রমে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীর অংশ পরবর্তীতে বদলে দিয়েছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের অনেক হিসেব, ভেঙে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আস্থার মেরুদণ্ড, রুখে দিয়েছিল তাদের বিদেশী সাহায্যের পথ! সেক্টর-১০, নৌ-কমান্ডো বাহিনী, দেশপ্রেম, সাহস ও বীরত্বের মিলিত গল্পই কালক্রমে রূপ নিয়েছিল এক সুইসাইডাল বা আত্মঘাতী মিশনে, যার নাম- অপারেশন জ্যাকপট।

অপারেশন জ্যাকপট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালিত সফল নৌ-গেরিলা অপারেশন যা যুদ্ধের মোড় অনেকাংশেই ঘুরিয়ে দিয়েছিল। যদিও মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত অনেক অভিযানও একই নামে অভিহিত ছিলো তবুও এই লেখনীতে বাংলাদেশের নৌ-কমান্ডো দ্বারা পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপটের কথাই তুলে ধরা হবে। যেটি কিনা শুধু হানাদার বাহিনীর মনোবলেই ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়নি বরং সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি।

পূর্বকথা

মূল অপারেশনের ঘটনায় যাবার আগে এর নেপথ্যের গল্পটা জেনে আসা যাক। ঘটনার প্রেক্ষাপট চিত্রায়িত হচ্ছিল সুদূর দক্ষিণ ফ্রান্সের উপকূলীয় শহর তুলনে। সেখানে তুলন ডকইয়ার্ডে পাকিস্তানি সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংরো তে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল ৪৫ জন ক্রুকে যাদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি। অপারেশন সার্চলাইটের ঘৃণ্য গণহত্যা ও নিপীড়নের কথা জানার পর তা স্তব্ধ করে দেয় সাবমেরিনার মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীকে। তিনি তখনই সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়ার। পাশাপাশি অন্যান্য বাঙালি ক্রুদেরও এ ব্যাপারে রাজি করানোর। তিনি তার পাকিস্তানি সহকর্মীদের কিছুই জানান নি কেননা তাদের দৃষ্টিতে এটি স্রেফ বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য হত। সাবমেরিন তীরে ভেড়ার সময় ওয়াহেদ বাঙালি ক্রুদের নিজের পরিকল্পনা জানাতে থাকেন তবে প্রতিবারে একজন একজন করে যাতে কিনা কোন আলাদা সাক্ষী না থাকে।

ওয়াহেদ ছিলেন জরুরী ও গোপন নথি রাখার সিন্দুকের নিরাপত্তার দায়িত্বে। তীরে সাবমেরিন ভেড়ার পর পরই তিনি সেখান থেকে ৪৫ জন ক্রু এর পাসপোর্টই নিজের লকারে নিয়ে আসেন। তার মতে, তিনি যদি শুধু বাঙালি ১৩ জনের পাসপোর্ট ই নিয়ে আসতেন তবে তা সন্দেহের উদ্রেক করতো। পরবর্তীতে ১৩ জনের মধ্যে ৮ জন দেশের টানে সাড়া দিয়ে তার সাথে যোগ দেন। এখানে উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বাঙালি সাবমেরিনারদের পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান ইনটেলিজেন্স একজন কে খুন করে ও আটজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

২৯ শে মার্চ ১৯৭১ এ এক দক্ষিণ আফ্রিকান বন্ধুর পরামর্শে তারা সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যেতে মনস্থ করেন। এটার সমূহ সম্ভাবনা ছিল যে ফ্রান্স পাকিস্তানের পক্ষে যাবে কেননা পাকিস্তান সরকার ফ্রান্সের কাছ থেকেই সাবমেরিনটি কিনেছিল। অপরপক্ষে সুইজারল্যান্ড যুদ্ধের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকায় তাদের পক্ষে সেখানে আশ্রয় নেয়া নিরাপদ হবে। আলমারী থেকে পাসপোর্টগুলো নিয়ে তারা একজন দু’জন করে তুলন ছেড়ে চলে যান। কিন্তু ফ্রেঞ্চ সীমান্তে গিয়ে তারা জানতে পারেন, সুইজারল্যান্ডে প্রবেশ করতে হলে তাদের ভিসা প্রয়োজন। যাতে কোন প্রকার সন্দেহ না করা হয় সেজন্য কর্তব্যরত নারীকে জানানো হয় যে তারা প্যারিস থেকে ভিসা নিয়ে আসবেন। এরপর তারা প্যারিসগামী ট্রেনে চড়ে স্পেনের লিওন এ নেমে যান, কেননা স্পেন এ প্রবেশের জন্য কোন ভিসার প্রয়োজন ছিলনা।

লিওন হয়ে বার্সেলোনায় গিয়ে ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে তাদের মাদ্রিদে পাঠানো হয়। দশ মিনিটের মধ্যে ভারতে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের কাগজপত্র তৈরি হয়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত হয় তারা রোমে গিয়ে নিউইয়র্ক থেকে ছেড়ে আসা ভারতগামী বিমানে উঠবেন। তারা রোমে পৌঁছবার পর দেখেন শ্রমিক ধর্মঘটের জন্য বিমানটি দেরী করে আসবে। এদিকে ভারতীয় দূতাবাস থেকে গণমাধ্যমে তাদের পালিয়ে আসার খবরটি চলে গেলে পাকিস্তান দূতাবাস থেকে তাদের নিয়ে যেতে অনেকে ছুটে আসেন। তারা জবাব দেন, “২৬ শে মার্চ আমরা নতুনরূপে জন্ম নিয়েছি। আমরা আমাদের দেশের জন্য লড়তে যাচ্ছি।” ইতালির সাথে পাকিস্তানের ভালো সম্পর্ক থাকায় দশ ঘণ্টা রোমে ওই বিমানের অপেক্ষা করার ঝুঁকি না নিয়ে তারা জেনেভায় চলে আসেন এবং এক ঘণ্টার মধ্যে বোম্বেগামী বিমানে চড়ে বসেন। সেখানে পৌঁছানোর পর তাদের দিল্লীতে বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্তটিও নেয়া হয়ে গিয়েছিল যে, এই ৮ জন নৌকমান্ডো হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছেন।

প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি পর্ব

আগস্ট মাসে ১৪৮ জন নৌ-কমান্ডোকে চারটি দলে ভাগ করা হয় দুটি সমুদ্র বন্দর (চট্টগ্রাম ও মংলা) ও দুটি নদীবন্দর (চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ) আক্রমণের উদ্দেশ্যে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে অস্ত্র ও রসদ আসার পথ ছিল দুটি- আকাশপথ আর জলপথ। আকাশপথ ইতোমধ্যেই ভারতীয় বাহিনী বন্ধ করে দেয়ায় নৌপথেই তারা প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান নিশ্চিত করছিল। তাদের প্রয়োজনীয় যোগান বন্ধ করতে এবং তাদের প্রতি বাড়িয়ে দেয়া বৈদেশিক সাহায্যের হাত রুখতেই এই বন্দরগুলো আক্রমণ করে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয়। এই অপারেশনের এও উদ্দেশ্য ছিল যে বিদেশী গণমাধ্যম কে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা জানানো এবং বিদেশী সহায়তাকারী রাষ্ট্রগুলোকে হুঁশিয়ারি দেয়া যে তাদের জাহাজ আর পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরে নিরাপদ নয়- যাতে আর জাহাজ মারফত পাকিস্তানিদের বৈদেশিক সহায়তা না পাঠানো হয়।

ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা ৮ জন হলেন: মোঃ আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, মোঃ সৈয়দ মোশাররফ হোসেন, মোঃ রহমতউল্লাহ, মোঃ শেখ আমানউল্লাহ, মোঃ আবদুর রকিব মিয়া, মোঃ আহসানউল্লাহ, মোঃ বদিউল আলম, মো আবদুর রহমান আবেদ। এরপর তাদের সাথে আরো কয়েকজন মিলে কুড়িজনের গেরিলা দল গঠন করে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদের সাথে কর্নেল ওসমানীর দেখা হলে তিনি নৌ-সেক্টর গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে ১৯৭১ সালের ২৩ শে মে নদীয়া জেলার পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে গোপন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়, যার সাংকেতিক নাম দেয়া হয় সি-টু-পি। নৌসেক্টর এর কোন সেক্টর কমান্ডার ছিলো না, তারা সরাসরি মুজিবনগর সরকারের অধীনে কাজ করতেন।

প্রায় তিনশ’র বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। দিনে ১৮ ঘণ্টা করে প্রায় ৩ মাস চলেছিল এই প্রশিক্ষণ। ব্যাপারটি এতটাই গোপনীয় ছিল যে তাদের কী ধরণের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তা যে এলাকায় অপারেশন চালানো হবে সেখানে নিয়োজিত মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডার ব্যতীত আর কেউ জানত না। প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই যোদ্ধাদের বলে দেয়া হয়েছিল যে এটি হতে যাচ্ছে আত্মঘাতী মিশন অর্থাৎ যে কোন মুহূর্তে প্রাণ দিতে হতে পারে। তাই শুরুতেই এই মর্মে স্বাক্ষর নেয়া হয় যে- “আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু হলে কেউ দায়ী থাকবে না।” প্রশিক্ষণটির দুটো ভাগ ছিল- স্থলযুদ্ধ প্রশিক্ষণ ও জলযুদ্ধ প্রশিক্ষণ। স্থলযুদ্ধে গ্রেনেড নিক্ষেপ, স্টেনগান চালানো, এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার, রিভলবার চালানো, আন-আর্মড কমব্যাট প্রভৃতির কলাকৌশল রপ্ত করতে হত। আর তীব্র খরস্রোতা ভাগীরথী নদীতে বুকে ৫-৬কেজি ওজনের পাথর বেধে সাঁতার, চিৎ সাঁতার, কোন রকমে পানির উপরে নাক ভাসিয়ে একটানা অনেকক্ষণ সাঁতার কাটা, সাঁতার এবং ডুব সাঁতার দেয়া অবস্থায় লিমপেট মাইনের ব্যবহার, স্রোতের প্রতিকূলে সাতার, জাহাজের কেবল ভাঙা ইত্যাদি কঠিন সব প্রশিক্ষণ দেয়া হত জলযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য। সকল যোদ্ধাকে একটানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করতে হত। এভাবে টানা প্রায় তিনমাসের প্রশিক্ষণের পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এ প্রশিক্ষণ শেষ হয়।

ত্রিপুরায় তাদের চূড়ান্ত নির্দেশ দেয়া হয়। আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৬০ জনের চট্টগ্রামগামী দলকে সাহায্যকারী হিসেবে সেক্টর-১, প্রতিটি ২০ জনবিশিষ্ট চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ এলাকাগামী দলকে সেক্টর-২ এবং ২৬০ জনের (৬০ জন নৌ এবং ২০০ জন সি.এন্ড.সি কমান্ডো) মংলাগামী দলকে সাহায্যের জন্য সেক্টর-৯ নিযুক্ত হয়েছিল। প্রত্যেক কমান্ডোকে একজোড়া সাঁতারের ফিন, একটি ছুরি, একটি লিমপেট মাইন, সাঁতারের পোশাক, শুকনো খাবার দেয়া হয়েছিল। প্রতি তিনজনের একজনকে একটি স্টেনগান ও গ্রেনেড দেয়া হয়েছিল। কারো কারো কাছে কম্পাস ছিল। দলনেতার কাছে ছিল ট্রানজিস্টর রেডিও। এগুলো নিয়ে ৩-৯ তারিখের মাঝে তারা হরিনা থেকে রওয়ানা হয়ে যান এবং ১২ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশে নির্ধারিত সেফ হাউজগুলোতে পৌছে যান।

অপারেশন জ্যাকপট কবে শুরু হবে তা এমনকি জেনারেল ওসমানীর কাছেও জানানো হয়নি। ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা দিবস পালন করবে তাই এই রকম একটা তারিখই আক্রমণের জন্য ধার্য করা হয়েছিল। দুটি বাংলা গানকে আক্রমণের নির্দেশ হিসেবে আকাশবাণীতে প্রচার করার কথা ছিল- প্রথম সংকেত ছিল “আমার পুতুল যাবে শ্বশুরবাড়ি” গানটি যার অর্থ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ করতে হবে বা আক্রমণের সময় কাছাকাছি। পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া “আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান” গানটি ছিলো দ্বিতীয় সংকেত যার অর্থ আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ কর। অর্থাৎ সুস্পষ্ট নির্দেশনা, আক্রমণ করতেই হবে। ১৩ ও ১৪ তারিখ গানদুটো বাজানো হয়। এই গান দুটিই যে সংকেত তাও শুধুমাত্র অপারেশনের কমান্ডাররাই জানতো। এ গোপনীয়তার কারণ ছিলো যদি কোন দল ইতোমধ্যে পাকসেনার নিকট ধরা পড়ে যায়, নির্যাতনের মুখেও যেন অপারেশন সম্পর্কিত কোন কার্যকরী তথ্য ফাঁস না হয়।

চট্টগ্রাম অপারেশন

অবশেষে ঘনিয়ে আসে সেই বিশেষ দিন। আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে থাকা ৬০ জনের দলটিকে ২০ জনের মোট তিনটি দলে ভাগ করা হয়। দুটো দল নির্দেশ মোতাবেক এগিয়ে কর্ণফুলি নদীর পূর্বতীরের নির্ধারিত বেইজক্যাম্প চরলক্ষ্যায় পৌঁছায় এবং দ্বিতীয় সংকেতটি পায়। তৃতীয় দলটি সময়মত এসে না পৌঁছনোয় এবং তাদের কোন হদিশ পাওয়া না যাওয়ায় তাদের ছাড়াই অপারেশনটি চালানো হয়। উপরন্তু ৯ জন কমান্ডো অপারেশনে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানালে চট্টগ্রাম অপারেশনে অবশেষে মোট ৩১ জন কমান্ডো অংশ নেন। ১৬ তারিখ রাতের প্রথম প্রহরে পৌনে দুটো থেকে সোয়া দুটোর মধ্যে কমান্ডোরা সন্তর্পণে জাহাজে মাইন লাগিয়ে সরে আসেন। ১ টা ৪০ এ প্রথম মাইন বিস্ফোরিত হয়। এরপর ক্রমাগত বিস্ফোরণে ৩ টি বড় অস্ত্রবহনকারী জাহাজ- এমভি আল আব্বাস, এমভি হরমুজ এবং ওরিয়েন্ট বার্জ নং ৬ ডুবে গিয়ে ১৯,০০০ টনের মত অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিনষ্ট হয়।পাশাপাশি অন্য ৭ টি নৌযানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

চাঁদপুর অপারেশন

চাঁদপুরে অপারেশনে সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বাধীন ২০ জনের দলের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। দুইজন অংশ নিতে অসম্মত হলে ১৮ জন তিনটি দলে ভাগ হয়ে এ অপারেশনে অংশ নেন। মোট ৪ টি জাহাজে তারা মাইন লাগিয়ে দেন এবং ৩ টি স্টীমার-জাহাজসহ আরো কিছু নৌযান ডুবে যায়। ১৬ আগস্ট রাত্রির প্রথম প্রহরে এ অপারেশন চালানো হয়েছিলো।

নারায়ণগঞ্জ অপারেশন

নারায়ণগঞ্জে চালানো এ অপারেশনটিও ১৬ আগস্ট বাস্তবায়িত হয়। সাবমেরিনার আবেদুর রহমানের নেতৃত্বে ২০ জনের দল শহরের ভেতর অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এ অপারেশনে অংশ নেন। ৪ টি জাহাজ-বার্জ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন নৌ-কমান্ডোরা।

মংলা অপারেশন

১৯৭১ এর মংলা অপারেশনের দায়িত্ব পান নৌ-কমান্ডো আমিনুর রহমান খসরুর নেতৃত্বাধীন ২৬০ জনের দলটি। ২৭ জুলাই ভারতের ক্যানিং মাটলার বন্দর থেকে রওয়ানা দিয়ে তারা ১৩ই আগস্ট মংলা পৌঁছান। ১৬ই আগস্ট রাত ১২ টা ১ মিনিটে তারা ডাংমারী জমিদারবাড়ি থেকে মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। মাইন লাগানোর শেষ সময় রাত দুটো হলেও পথনির্দেশক আফজালের ভুলের কারণে সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে ৪ টা বেজে যায়। ততক্ষণে অন্য্যান্য সব জায়গার অপারেশন চালানো শেষ। এ কারণে মংলা বন্দরে নোঙর করা ১৪ টি জাহাজের সবগুলোকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। কমান্ডার আমিনুর রহমান দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন যে, ৬ টি জাহাজে মাইন লাগানো হবে। তাই পরিশেষে এই অপারেশনে ২৪ জন নৌ-কমান্ডো অংশ নেন। আর দলের ২০০ জন সি.অ্যান্ড.সি কমান্ডো ৩ জনের ৬৬ টি উপদলে ভাগ হয়ে নৌ-কমান্ডোদের কভার দিতে মংলা বাঁধের পেছনে অবস্থান নেন। এ দলের সাব-কমান্ডার রাজা ও খিজির নৌ-কমান্ডোদের সহায়তাকল্পে পশুর নদীর হাঁটুপানিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেশিনগানসহ নেমে আসেন।

অপারেশন শুরু হয় ৪ টা ৩০ মিনিটে। ২৪ জন নৌ-কমান্ডো ৬ টি ছোট দলে বিভক্ত হন (প্রতিটি ছোটদলের ১ জন করে দলনেতা ছিল) এবং ৬ টি বিদেশী জাহাজে মাইন লাগান। ভোর ৬ টা ৩০ থেকে শুরু হওয়া বিস্ফোরণে জাহাজগুলো ধ্বংস হয়। এগুলোর মধ্যে একটি করে সোমালীয়, মার্কিন, জাপানি ও পাকিস্তানী জাহাজ এবং দুইটি চীনা জাহাজ ছিল। এ অপারেশনে পশুর নদীতে মোট ৩০,০০০ টন গোলা-বারুদ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম ডুবে যায়। মংলা অপারেশনে অপারেশন কমান্ডার আমিনুর রহমান খসরু এবং আরো ২ জন নৌ- কমান্ডো মংলা বন্দরের অতিরিক্ত বাধা পার হয়ে অপরিসীম সাহসের সহিত সোমালীয় ৭,০০০ হাজার টনের অস্ত্রবাহী জাহাজ এসএস লাইটং এ মাইন লাগিয়ে তা ধ্বংস করেন। এই অপারেশনে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা নিখোঁজ হন।

আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এ কমান্ডো বাহিনীর ৮ জন শহীদ হন, ৩৪ জন আহত হন এবং ১৫ জন ধরা পড়েন। এ সময়ের মধ্যে ৪৫ টিরও বেশি নৌযান ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হন নৌ-কমান্ডোরা। কোনো রকম নিজস্ব নৌযান না থাকা সত্ত্বেও নৌ-কমান্ডোরা কমপক্ষে ১০০,০০০ টন নৌযান ডুবানো বা বিকল করার পাশাপাশি, জেটি এবং বন্দর অকার্যকর করতে ও চ্যানেলসমূহ বন্ধ করে দিতে সক্ষম হন। এছাড়াও বিবিসি, ভয়েস অফ অ্যামেরিকা সহ অনেক গণমাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানের প্রকৃত পরিস্থিতি প্রচার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ বহির্বিশ্বে পায় অন্যরকম পরিচিতি।

এই মিশন আক্ষরিক অর্থেই আত্মঘাতী ছিল কেননা বুকে মাইন বেঁধে সন্তর্পণে সাঁতরে জাহাজে তা লাগিয়ে আসতে হতো- যে কোন সময় বাজতে পারতো এলার্ম কিংবা ঘটতে পারতো বিস্ফোরণ, অন্যান্য প্রাণঝুঁকির সঙ্গে ছিলো ধরা পড়ার ঝুঁকি। আনুভূমিকভাবে কয়েকটি জাহাজ পরপর ডুবিয়ে দিলে তা বন্দর বিকল করে দিতে পারে বিধায় নির্দিষ্ট ভাবে জাহাজ ডুবানোর জন্য বিশেষভাবে কাটতে হতো মাইন লাগানো জাহাজের কেবল। এই সকল প্রাণঝুঁকি নিয়েই অপারেশন জ্যাকপটে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। যে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তারা তা সর্বদাই বিনম্র শ্রদ্ধার দাবিদার।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে তাদের নানা খেতাবে ভূষিত করা হয়- আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (বীর উত্তম), মোহাম্মদ শাহ আলম (বীর উত্তম), মোশাররফ হোসেইন (বীর উত্তম), মোজাহার উল্লাহ (বীর উত্তম), শেখ মোহাম্মদ আমিন উল্লাহ (বীর উত্তম), আবেদুর রহমান (বীর উত্তম), মোহাম্মদ খবিরউজ্জামান (বীর বিক্রম), মমিন উল্লাহ পাটওয়ারী (বীর প্রতীক), শাহজাহান কবীর (বীর প্রতীক), ফারুক-এ-আজম (বীর প্রতীক), মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ (বীর প্রতীক), মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেইন (বীর প্রতীক), আমির হোসেইন (বীর প্রতীক), মোহাম্মদ খোরশেদ আলম (বীর প্রতীক)।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অপারেশন জ্যাকপট ছিলো অপরিসীম গুরুত্ববহ। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেই সকল বীর যোদ্ধাদের স্মৃতি ও সাহসিকতার পরিচয় সর্বদাই গর্বের কালিতে লেখা থাকবে।

সূত্র:

1. https://goo.gl/LhTB46
2. https://goo.gl/Ck8qxk
3. https://goo.gl/jNCShN
4. https://goo.gl/cRddRh
5. https://goo.gl/27U8q1
6. https://goo.gl/IF5fAp
7. https://goo.gl/DL17Tz
8. https://goo.gl/uLBrhp
9. https://goo.gl/ptnX8K
10. https://goo.gl/ZdjXNX