আমাকে ঘিরে
কলস্বরে ডেকে যায় পাখি, ভূতপ্রেতের থাকে নানা ইশারা ভঙ্গি
আজ এই মধ্যরাতে আমাকে হাতিয়ে নিয়ে
গালভরে কথা বলে ভাবগম্ভীর আরণ্যক নীরবতা
দেখো তো হৈমন্তিক জ্বরে কতকাল শুয়ে আছি
ধূসর চাদর পেতে উঁচু-নিচু পাহাড়ে-টিলায়
চূড়ায় হারানো পাখি অকাতরে গ্রেফতার করি এ আজ
একমাত্র কাজ। পাখিদের সংসারে
তীর-ধনুক উড়ে এলে তাও যেন গেঁথে নেই নিজের শরীরে
আর আছে সাপখোপ, জিন্দা লাশ, মৃত রূপসীর ত্বক
কখনও বাসনা হলে সাপেই ছোবল মেরে শান্ত করে দেবে
জিন্দা লাশ টেনে নেবে মৃত রূপসীর
ফোঁড়া ওঠা সমাধী-ত্বকের নিভৃত ছায়ায়
তবুও জানিও তোমার গৃহসুখ ছিঁড়ে কারা
হালফ্যাশনের কাজে অবাধে মানিয়ে নিয়েছে
আমি তো চূড়ায় বসে তপ্ত বিষ গিলে-শুষে
তোমারই সংসার ঘিরে চিরদিন অমর হয়েছি
যারা বলছে না
যারা বলছে না, তাদের কাছে সদ্য প্রশিক্ষিত
হাঁটা ও ওড়ার পদ্ধতি জমা রেখে দূরে গিয়ে বসি
অনন্তকাল ধরে নদীর ওপর উড়ে বেড়ানো চিলের
সঙ্গম পদ্ধতি কল্পনা করে জলে নেমে শীতল হতে থাকি
আজ থেকে আমাকে আশ্রয়দাতা ভেবে জলের চঞ্চল প্রাণী
কামড়ে-চেটে সোহাগ করে যায়
তারা আমাকে বলে জলের গোপন কথা, চিল-সারসের
অবিশ্বস্ত থাবায় মাছেদের জীবনাশঙ্কার কথা
তাদের উৎসব থেকে নানা প্রকার খাবার-খাদ্য, ফানুস ওড়ানো দেখে
কখন যে রপ্ত হয়ে যায় এই জলে সন্তরণরীতি!
এবার জলের অতলে হাত-পা-কান বন্ধক রেখে
নানা বরণ পাখনা লাগিয়ে একূল থেকে ওকূল সাঁতরে বেড়াতে থাকি
যারা বলছে না, তারা দেখছে
আমার গচ্ছিত হাঁটা ও ওড়ার পদ্ধতি হাতিয়ে নিয়ে তারা
একবার মরু একবার আকাশে
সারি সারি বৃক্ষ রোপণের কথা ভাবছে
অঘ্রাণের যৌবনের ভেতর
যার হাতের ভেতর সারা দেহ এলিয়ে দিয়ে বসে আছ
তাকে ডাকছে হেমন্তের রৌদ্রলাল বিকেলের ভাষা
এইমাত্র আকাশ থেকে নেমে
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, পোশাকাদি বদলে নিচ্ছ জানি
আবার সন্ধ্যা নামবে
সামুদ্রিক লবণের মতো শরীর জুড়ে জাঁপটে ধরবে শীতের মস্করা
যার হাত এখন শিক্ষায়তনের সমাপনী কোর্সের মতো
ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভাবছে
একটি পুরুষ বৃক্ষের দিকে তাকালে মুহূর্তে স্ত্রীবৃক্ষ হয়ে
নব আনন্দে সংসার পাতছে
আর পানাপুকুরের জলে ফুলগুলো ভেসে বেড়ানো দেখে
নিজের সন্তান ভেবে আদরে সোহাগে ভরিয়ে তুলছে
আজ তার হাতের এই নির্বিঘ্ন আশ্রয় একদমই মুক্তি দিচ্ছে না
আজ চারদিক দিয়ে অঘ্রাণের যৌবনের ভেতর লুক্কায়িত
কৃষকের গোপন হাউসের কথা ভাবছি
টেলিপ্রিন্টের ছায়ায় বড় হতে থাকা স্বপ্নগুলো ফ্রেমবন্দি করে
পৌঁছে যাচ্ছি মাঠভর্তি পাকা ধানের সোনালি পৃষ্ঠায়
অদূরেই কুয়াশার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে কারা যেন
পুড়িয়ে খাচ্ছে ইলিশের ডানা
তুমি আশ্রিত হাতের কররেখা ছিঁড়ে
আমি উলেভরা ধানের অক্ষর উড়িয়ে
পদ্মাপারের কৈবর্তপাড়ায় সম্পর্কের বিনির্মাণে
আধুনিক-উত্তর গবেষণাগারে কিছুদিন কাটাবো বলে ভাবছি
আর চাইবো না
ভোরবেলা আর তোমার কাছে কিছু চাইবো না
সারারাত্রি চেয়ে চেয়ে জ্যোৎস্না দিয়ে সূর্য ঢেকেছি
কম্বল দিয়ে গ্রীষ্ম ঢেকেছি আর অমন
মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হিমালয়ের মৃত্যু দেখেছি
এ-কথা জানানো হয়নি, আমার চাইবার দিন
সহস্র বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে
যখন তোমার নাভিতে বসে খেলে যেত ইঁদুরছানারা
দু’জনের নখ কেটে দিতÑ দেয়ালের টিকটিকিগুলো
এতটা নির্জন ঘরে টিক টিক করে ঘোষণা করত ‘সত্যি’
ভাবছি, আজ ভোরবেলা গাছের গুড়ি ফেলে
পৃথিবীর বন্দর-নগর-রাজপথ-গলি স্তব্ধ করে দেবো
তুমি চাইলেই কেবল মুক্ত করে দেবো অকাতরে খরস্রোতা নদী
সমুদ্রবিষয়ক
ক্রমাগত সমুদ্রের পৃষ্ঠাগুলো উল্টে যাচ্ছে পাছে
মুদ্রিত হচ্ছে সদ্য রচিত ব্যাকুল পাণ্ডুলিপি…
পৃষ্ঠাগুলোর ভাঁজে ভাঁজে অমারাত্রিক ছায়া
ছায়াদের লবণাক্ত শরীরের ভেতর নিমজ্জিত হয়ে
দেখা যায় গৃহবিবাদ, দাম্পত্য কলহ আর
লোকচক্ষুর অন্তরালে দেবতাদের আদিম জৈবিক জীবন
সৈকতে দাঁড়িয়ে দেখার স্বপ্ন সুদূর পরাহত বলে
আকাশ থেকে বড়শি ফেলে এসব সামুদ্রিক দৃশ্য তুলে এনে
অন্তরীক্ষে তারকালোকে ঝুলিয়ে দেয়া জরুরি
কেননা তাদের হাতেই নির্ভর করছে আমাদের বাঁচামরা
মৃত্তিকাশ্রয়ী বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন
নিদানকালে
ছায়াদের দীর্ঘশ্বাস পড়ে জেগে উঠেছে অগণিত প্রাচীন ইঁদারা
গুটি বসন্তে ঝলসানো মুখের মতো এই আরণ্যক দৃশ্যের কিছু
পাতাঝরা, বাউকুড়ানির খেলা
সেই কবেই না চলে গেছে লোকচক্ষুর আড়াল দাপিয়ে
আমার চিরচঞ্চল ডানায় কিছু মেঘ, দাঁতের শিরশিরে ব্যথায়
সুগন্ধি ফুলের ইশারা এমন অরণ্যের দিকে টানছে
আর ভুল করে স্বনামধন্য কিছু ব্যক্তিত্ব বরাবর
আমার সেলাই করা হস্তাক্ষরের নমুনাপত্র প্রেরণ করেছি
গভীর অরণ্যে তারা পৌঁছে গেছে বাঘ সিংহ হিংস্র ভল্লুকের হাতে
এমন নিদানকালে আর কী করে পা বাড়াই বলো?
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
ওবায়েদ আকাশের জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৩ জুন, বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার সুলতানপুর গ্রামে। একাডেমিক পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। পেশা সাংবাদিকতা।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :
পতন গুঞ্জনে ভাসে খরস্রোতা চাঁদ (বর্তমান সময়, ২০০১), নাশতার টেবিলে প্রজাপতিগণ (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৩), দুরারোগ্য বাড়ি (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৪), কুয়াশা উড়ালো যারা (বিশাকা, ২০০৫), পাতাল নির্মাণের প্রণালী (আগামী, ২০০৬), তারপরে, তারকার হাসি (আগামী, ২০০৭), শীতের প্রকার (বৃক্ষ, ২০০৮), বিড়ালনৃত্য, প্রেতের মস্করা (শুদ্ধস্বর, ২০০৯), যা কিছু সবুজ, সঙ্কেতময় (ইত্যাদি, ২০১০), প্রিয় কবিদের রন্ধনশালায় (ইত্যাদি, ২০১১), রঙ করা দুঃখের তাঁবু (ইত্যাদি, ২০১২), বিবিধ জন্মের মাছরাঙা (দীর্ঘ কবিতার সংকলন, ইত্যাদি, ২০১৩), তৃতীয় লিঙ্গ (দীর্ঘ কবিতার সংকলন, শুদ্ধস্বর, ২০১৩), উদ্ধারকৃত মুখম-ল (বাংলা একাডেমি কর্র্তৃক প্রকাশিত নির্বাচিত কাব্য সংকলন, ২০১৩), হাসপাতাল থেকে ফিরে (কলকাতা, উদার আকাশ, ২০১৪), ৯৯ নতুন কবিতা (ইত্যাদি, ২০১৪)।
অনুবাদ :
‘ফরাসি কবিতার একাল / কথারা কোনোই প্রতিশ্র“তি বহন করে না’ (ফরাসি কবিতার অনুবাদ, জনান্তিক, ২০০৯)
‘জাপানি প্রেমের কবিতা/ এমন কাউকে ভালবাস যে তোমাকে বাসে না’ (জাপানি প্রেমের কবিতা, জনান্তিক, ২০১৪)
গদ্যগ্রন্থ : ‘ঘাসের রেস্তরাঁ’ (বৃক্ষ, ২০০৮) ও ‘লতাপাতার শৃঙ্খলা’ (ধ্রুবপদ, ২০১২), চারদিকে উদ্যানের সৌরভ (ধ্রুবপদ, গল্পগ্রন্থ, ২০১৪)।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : অনুবাদ : গদ্যগ্রন্থ :ম্পাদনা গ্রন্থ :সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন : পুরস্কার ও সম্মাননা: সম্পাদনা গ্রন্থ : ‘দুই বাংলার নব্বইয়ের দশকের নির্বাচিত কবিতা’ (শিখা, ২০১২)।
সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন : শালুক (১৯৯৯)
পুরস্কার ও সম্মাননা:
‘শীতের প্রকার’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম শ্রেষ্ঠ তরুণ কবি পুরস্কার ২০০৮’;
‘শালুক’ সম্পাদনার জন্য ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র পুরস্কার ২০০৯’।
এবং সামগ্রিক কাজের জন্য লন্ডন থেকে ‘সংহতি বিশেষ সম্মাননা পদক ২০১২’।