প্রচ্ছদ ফিচার ষড়ৈশ্বর্য ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে আসুক নারী

ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে আসুক নারী

সবুজ ঘাসের মাঠে ছোটাছুটি করতে খুব ভালোবাসে রাফিয়া। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌড়ে সব সময় কোনো না কোনো পুরস্কার জিতে নেয় সে। পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিলে ফুটবল খেলা, বাড়ির পুকুরে সাঁতার সবকিছুতেই তার জুড়ি মেলা ভার। শরীরে তার প্রাণশক্তি অফুরন্ত। কিন্তু একটু বড়ো হতে না হতেই গ্রামের মানুষ নানারকম কথা শোনাতে থাকে তার মা-বাবাকে। সে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলে। নদীতে সাঁতার দেয়। গাছে চড়ে। এগুলো নাকি ‘পুরুষালি স্বভাব’। এমন করে বেড়ালে নাকি মেয়ের কখনো বিয়ে হবে না।

রাফিয়ার বয়স তখন তেরো-চৌদ্দ বছর। বাবা-মা কড়া শাসন করে তার বাইরের খেলাধুলা, ঘোরাঘুরি বন্ধ করলেন। বললেন, খেলতে চাও, পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে বসে পুতুল খেল, রান্নাবাড়ি খেল। রাফিয়া শত কান্নাকাটি করেও মাঠে খেলার অনুমতি আদায় করতে পারেনি। এর দুই বছর পর তার বিয়ে হয়ে যায়। চলে আসতে হয় শহরে। সংসারে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি সবার মন জুগিয়ে চলতে হয় তাকে। কারও কথার কোনো প্রতিবাদ করে না। কিন্তু তার নিজের মেয়ে যখন স্কুলে খেলাধুলায় অংশ নিতে থাকে, তখন মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। রাফিয়ার মেয়ে স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়। সে স্কুলের নারী ক্রিকেট দলে নাম লেখায়। রাফিয়ার স্বামী ও শাশুড়ি আপত্তি তোলে। বলে, রাফিয়া নাকি আদর দিয়ে মেয়ের স্বভাব খারাপ করে দিচ্ছে। কিন্তু এবার রাফিয়া প্রতিবাদী হয়। তার মেয়েকে সে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে সর্বশক্তি দিয়ে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। রাফিয়ার মেয়ে এখন কলেজে পড়ছে। পাশাপাশি জেলা নারী ক্রিকেট দলে সুযোগ পেয়েছে।

এভাবেই বদলে যাচ্ছে দিন। বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে আসছে ক্রীড়াক্ষেত্রে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদরা দেশকে অনেক সাফল্য উপহার দিয়েছেন।
তারা দেশের বাইরে বাংলাদেশের পতাকাও বহন করছেন। বিদেশের মাটিতে ফুটবল, সাঁতার, কাবাডি, শুটিং ও ভারোত্তোলনে স্বর্ণপদক জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন।

জাতীয় প্রতিযোগিতায়ও পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই নারী। তারা ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার, দাবা, টেনিস, টেবিল টেনিস, ভারোত্তোলন, কাবাডি, কুস্তি, হ্যান্ডবল, ভলিবল, শুটিংসহ বিভিন্ন ক্রীড়া ইভেন্টে অংশ নিচ্ছেন।
বাংলাদেশের একজন সফল ক্রীড়াবিদ নারী জোবেরা রহমান লিনু। তিনি ষোলোবার জাতীয় টেবিল টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে’ নাম তুলে ইতিহাস তৈরি করেছেন। জোবেরা রহমান লিনু মনে করেন, নারীকে ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হলে সামাজিক পরিবেশ তার জন্য অনুকূল করে তুলতে হবে। তিনি আরও মনে করেন, যদি খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পাওয়ার সুযোগ থাকে অথবা নারী ক্রীড়াবিদদের জন্য আর্থিক অনুদান থাকে, তাহলে আরও অনেক নারী ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত হবেন, পরিবার থেকেও বিষয়টিতে আগ্রহ সৃষ্টি হবে।

ফুটবলে নারীর সাফল্যের দিকে তাকালে দেখা যায়, সম্প্রতি সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ ফুটবলে পাকিস্তানকে ১৭-০ গোলে হারিয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ মহিলা ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ফাইনালে ১-০ গোলে ভারতকে হারায় বাংলাদেশ। ক্রিকেটেও নারীর ঈর্ষণীয় অর্জন অনেক। এশিয়ার পরাশক্তি ভারতকে ফাইনালে তিন উইকেটে হারিয়ে প্রথমবার এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট জিতে ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। টানা পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে নজির স্থাপন করে মেয়েরা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাফল্যে যোগ হয়েছে আরেকটি প্রাপ্তি। জিম্বাবুয়ে লক্ষ্য ছিল প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত করা। তা সঙ্গে করে নিয়েই দেশে ফিরেছেন নিগার সুলতানা জ্যোতি, রোমানা আহমেদ, সালমা খাতুনরা। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব খেলতে চলতি বছর ২০২১-এর নভেম্বরের শুরুতে জিম্বাবুয়ে গিয়েছিল নিগার সুলতানার নেতৃত্বাধীন দল। সেখানে প্রথমে স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের সবকটি ম্যাচই জেতে বাংলাদেশ নারী দল, যা বিশ্বকাপ বাছাইয়ের জন্য জোগায় বাড়তি আত্মবিশ্বাস। বিশ্বকাপে যাওয়ার টিকিট নিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন তারা।
দাবা জনপ্রিয় ইভেন্টের মধ্যে একটি। আশির দশকে একাধিকবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন রানী হামিদ। বিদেশেও তিনি দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন। এরপরই ইয়াসমিন বেগম, শাবানা পারভীন নিপা, শামীমা আক্তার লিজাসহ আরও অনেক নারী জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। শুটিংয়ে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে চলেছেন নারী। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে এ ইভেন্টে নারীদের উত্থান হয়। ২৫ বছরে শত শত নারী শুটার সৃষ্টি করেছে শুটিং ফেডারেশন। এই শুটাররা জাতীয় প্রতিযোগিতায় নিয়মিতই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

জাতীয় অ্যাথলেটিকসের ৪০তম আসরের দ্রুততম মানবী হয়েছেন বাংলাদেশ নৌবাহনীর শিরিন। ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশীয় গেমসে ৬৩ কেজি শ্রেণিতে স্বর্ণপদক জয় করেন মারিয়া আক্তার সীমান্ত। আশির দশক থেকে সাঁতারের আঙিনায় প্রবেশ করা নারী নব্বইয়ের দশকেই মূলত সাঁতারে প্রভাব বিস্তার করেন।

নিবেদিতা দাস। বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল এডুকেশন বিভাগের অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর। সদ্যসমাপ্ত টোকিও অলিম্পিকে তিনি বাংলাদেশ দলের সাঁতারের কোচ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি মনে করেন, অলিম্পিকে সাফল্য পেতে হলে অনেক বছরের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে। প্রাথমিক স্কুল পর্যায় থেকেই ক্রীড়াবিদ তৈরির বিষয়টিকে মাথায় রাখতে হবে। বিশেষ প্রশিক্ষণ ও শরীরগঠনেরও বিষয় রয়েছে। তিনি নিজে কৃতী সাঁতারু। জীবনে বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বমোট ৭৮টি পদক জয় করেছেন। তিনি জাতীয় পর্যায়ে একাধিক স্বর্ণপদকজয়ী কৃতী সাঁতারু।
নিবেদিতা মনে করেন, বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুলে সাঁতার বাধ্যতামূলক বিষয় হওয়া উচিত। সাঁতার শুধু ক্রীড়া হিসাবে নয়, জীবন বাঁচানোর একটি প্রয়োজনীয় শিক্ষা হিসাবেও গ্রহণ করা উচিত। তিনি মনে করেন, যদি সাঁতার প্রতিটি স্কুলে বিষয়ভিত্তিকভাবে থাকে, সেখানে নম্বর প্রদানের নিয়ম থাকে, তাহলে প্রত্যেক ছেলেমেয়েই সাঁতার শিখবে। এজন্য সুইমিংপুলগুলোকে কয়েকটি স্কুল সমন্বয় করে ব্যবহার করতে পারে।

নারীদের ক্রীড়াক্ষেত্রে এগিয়ে আসার জন্য সামাজিক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে দূর করতে হবে। ঢাকা বিশবিদ্যালয়ে যেন আরও বেশি কৃতী ক্রীড়াবিদ ছাত্রছাত্রী পাওয়া যায়, সেজন্য ভর্তির সময় ক্রীড়া কোটা থাকা দরকার বলেও তিনি মনে করেন। অলিম্পিকে সাফল্যের জন্য ক্রীড়াক্ষেত্রে আরও মনোযোগী হতে হবে সরকার থেকে ব্যক্তিপর্যায়ে। ছোটোবেলা থেকেই সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে শিশুকে গড়ে তুলতে হবে।
আজকের শিশু আগামী দিনের গর্বিত নাগরিক। সুস্থ-সবল জাতি গড়ে তুলতে হলে খেলাধুলাকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। মেয়েশিশুরা যদি খেলাধুলার মাধ্যমে শরীরগঠন করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে তারা সুস্থসবল জাতির নাগরিক হয়ে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবে।

ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীকে এগিয়ে নিতে হলে সামাজিক কুসংস্কার, কুপ্রথা ও পশ্চাৎপদ মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া শিক্ষক থাকতে হবে এবং নারীর খেলাধুলাকে উৎসাহিত করতে হবে। ভালো নারী খেলোয়াড়ের জন্য থাকতে হবে আর্থিক প্রণোদনা, বৃত্তি ও উপবৃত্তি। তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামে ও শহরের প্রতিটি স্কুলে মাঠ থাকাটা বাধ্যতামূলক করা দরকার।
ক্রীড়াক্ষেত্রে আরও এগিয়ে আসুক বাংলাদেশের নারী। প্রিয় লাল-সবুজ পতাকাকে, প্রিয় জাতীয় সংগীতকে তারা পৌঁছে দিক বিশ্বের সর্বত্র।

শান্তা মারিয়া, পিআইবি ফিচার

Exit mobile version