প্রচ্ছদ অর্থনীতি ছাত্র রাজনীতির সাদামাটা সেই মানুষটি

ছাত্র রাজনীতির সাদামাটা সেই মানুষটি

1076
শিতিন মন্ডল
বোরহান বিশ্বাস: ৮০ এর দশকের শেষ ভাগে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অবিভক্ত সবুজ থানা (খিলগাঁও-সবুজবাগ-মুগদা এলাকা) ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালিন সভাপতি ছিলেন শিতিন মন্ডল ’। তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে ওই সময় থানা ও কেন্দ্রিয় পর্যায়ে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলনে জেল খেটেছেন। স্বৈরাচার পতনের পর আরেক নব্য স্বৈরাচারের (বিএনপি) সময়ও মিথ্যা মামলায় তাকে জেলে যেতে হয়। বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগের আদর্শকে ধারণ করেই এগিয়ে গেছেন সামনে। ’৯০- এ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দলে সুবিধাবাদীদের আধিপত্যে ক্রমেই পিছিয়ে পড়েছেন। তবুও বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনায় অবিচল আস্থা রেখেছেন। জীবিকার তাগিদে শাহজাহানপুরের একটি স্টিল আলমারির দোকানে এখন কাজ করছেন। স্ত্রী আর তিন মেয়ে সঞ্চিতা, অর্পিতা আর পুষ্পিতাকে নিয়ে তার সংসার। কোনো পদে না থেকেও আওয়ামী লীগের কর্মসূচিগুলোতে নিজেকে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করেন। কিভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তিনি জড়িয়েছিলেন, নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। আর কেনোইবা পিছিয়ে পড়লেন এসব জানতেই সম্প্রতি কথা হয় শিতিন মন্ডলের সঙ্গে:
ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হলেন কিভাবে?

৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রায়ই আমি ধানমন্ডি ৩২ এ যেতাম। আমার সঙ্গে সব সময়ই কিছু বন্ধু থাকতো। সেখানে শহীদুল্লাহ ভাইয়ের (তৎকালিন অবিভক্ত ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি) সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আমাকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ছাত্রলীগের কার্যালয়ে দেখা করতে বলেন। পরে সেখানে গেলে আমাকে ছাত্রলীগ করার উৎসাহ দেন। এক সময় ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হই আমি। সেই থেকে শুরু…

১৯৮৮ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে নবনির্বাচিত কমিটির সদস্যদের তালিকা

অবিভক্ত সবুজবাগ থানার সভাপতি কিভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন?

গোড়ান এলাকা তখন ছিল মতিঝিল থানার আওতাধীন। ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড ছিল এটি। ওই সময় ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম আমি। ১৯৮৭ সালে নতুন দুটি থানা সবুজবাগ ও উত্তরা গঠিত হয়। তখন বৃহত্তর সবুজবাগ থানা (সবুজবাগ, খিলগাঁও, মুগদা ও ডেমরার কিছু অংশ নিয়ে) তৈরি হয়েছিল। সেই সবুজবাগ থানা ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক করা হয় আমাকে। পরের বছর ৮৮ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে আমাকে সবুজবাগ থানার ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই সময় অবিভক্ত ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন কে এম শহীদুল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এস এম মান্নান কচি।

ছাত্রনেতা হিসেবে তখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনও তো করতে হয়েছে-

এটা সাংগঠনিক কর্মকান্ডের অংশ হিসেবেই আমার ওপর বর্তায়। ১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার পর মিথ্যা মামলার অজুহাতে আমাকে জেলে নেয়া হয়। পরে বেরিয়ে এসে আবার আন্দোলনে যোগ দিই। ওই সময় আমি সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রী কলেজের ছাত্র। পুলিশী নির্যাতনের মুখেও তখন সবুজবাগ এলাকায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে আন্দোলন চালিয়ে যাই। সেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতিও ছিলাম আমি। জাসদ ছাত্রলীগ, ছ্ত্রা ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মোজাফফর হোসেন পল্টু ভাই। মায়া ভাই, নাসিম ভাই, ওবায়দুল কাদের ভাইসহ অনেক নেতার সঙ্গে আমরা বিভিন্ন সময় আন্দোলনের বিষয়ে পরামর্শ নিয়েছি।

সম্মেলন ’৮৮-এর পোস্টার

ওই সময় আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কূটকৌশল হিসেবে এরশাদ ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙা নিয়ে বাংলাদেশেও একটি সময় ইস্যু তৈরি করে। বিভিন্ন মন্দিরে হামলা ও ভাংচূর হয়। ওই সময় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা দলমত নির্বিশেষে মিছিল করি। এর পর পরই আমাদের পরিবারের ভাড়া নেয়া ছোট্ট একটি ওয়ার্কশপ ভেঙে দেয়া হয় এবং লুট করা হয়। পরবর্তী সময় বাসাবো রাজারবাগ কালীবাড়ী মন্দিরে বসবাসরত হিন্দু সম্প্রদায়কে অভয় দিতে আমরা ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সেখানে যাই। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কমিটি করি। পরে মহানগর সভাপতির সঙ্গে বৈঠক করে আমরা আওয়ামী লীগ সভাপতি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে আসি। একই মঞ্চে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীর সামনে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বক্তৃতা করি এটি আমার জীবনের একটি পরম পাওয়া।

তো সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসলেন কেনো?

এরশাদ হঠাও আন্দোলনে সফল হওয়ার পর সম্মেলনের মাধ্যমে সভাপতির পদ থেকে আমি সরে দাঁড়াই। এরপর ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসেন বেগম খালেদা জিয়া ।তখন মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে জেলে নেয়া হয়। বেশ কিছুদিন জেল খাটার পর বের হয়ে খালেদা বিরোধী আন্দোলনে আবার রাজপথে নামি। ওই সময় ছাত্রলীগে না থাকলেও ঢাকা মহানগরের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলাম। একটা সময় লক্ষ্য করলাম দলের কিছু নেতারা সুবিধাবাদিদের কাছে টানছেন। কষ্ট পেলাম। নীতি-আদর্শকে দূরে ঠেলে সুবিধাবাদিরা দলে জায়গা করে নিতে লাগলো। আর আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মেনে চলি, তার নাম ব্যবহার করে ফায়দা নিতে পারি না তারা ক্রমেই পিছিয়ে পড়তে লাগলাম। একদিকে আমরা যেমন উপেক্ষিত হচ্ছিলাম, অন্যদিকে সুবিধাভোগিরা পদ-পদবী নিয়ে ততই বেপরোয়া হয়ে উঠলো। তখন নিজেকে রাজনীতি থেকে অনেকটা গুটিয়ে নিলাম। তবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও জননেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা তখনো ছিল, এখনো আছে। পদে না থাকলেও আওয়ামী লীগের প্রায় সব কার্যক্রমেই উপস্থিত থাকার চেষ্টা করি। রাজপথের অনেক সহযোদ্ধা বন্ধুরা এমপি হয়েছে, ব্যাংকার হয়েছে, সুবিধাজনক অবস্থানে গেছে। তাদের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। কিন্তু কখনো কিছু চাই না। চাওয়া সম্ভব না।

৯০-এ ছাত্রলীগের সম্মেলনে পদ ছাড়ার আগে সভাপতি হিসেবে বক্তব্য

কেমন বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখেন?

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার দুর্নীতি ও মাদকমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় তার সঙ্গে সব সময় আছি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবো। আমার নেত্রী শেখ হাসিনা আজ দেশের উন্নয়নের জন্য যে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মুষ্টিমেয় কিছু সুবিধাবাদি লোকের জন্য মানুষের কাছে সেই বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছেনা। উল্টো দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। আমার মতো বঞ্চিত, উপেক্ষিতরাই শুধু নয় সর্বস্তরের মানুষ জননেত্রীর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। দলের স্বার্থে এটা প্রয়োজন ছিল।

চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কি মিলেছে?

পাওয়ার জন্য কখনো রাজনীতি করি নাই। আজ গর্ব করে বলতে পারি, সারাদিনে একটা কলা-রুটি খেয়ে অনেক সফল অনুষ্ঠান করেছি। দলের জন্য উৎসর্গ ছিলাম বলে ওই কাজ করতে পেরেছিলাম। এখন তো অনুষ্ঠানের জন্য লাখ-লাখ টাকা তোলা হয়। আবার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারিও হয়। ছাত্রলীগ করার সময় ঘরে ঘরে গিয়ে কর্মীদের খোঁজ-খবর নিয়েছি। বিপদে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। এখন ছাত্রলীগ করা ছেলেরা কোনো কিছু চাইলেই পেয়ে যায়। যে কারণে তারা তৃণমূলের সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। ফলে, ভিত্তিটাও সেভাবে মজবুত হয় না। অর্থের বিনিময়ে পদ পাওয়ায় আদর্শের জায়গা থেকে তারা দূরে সরে গেছে।

ছাত্র রাজনীতির সেকাল-একালে কি পার্থক্য খুঁজে পান?

৮০, ৯০ দশকে বিভিন্ন দলের হয়ে আমরা যারা ছাত্ররাজনীতি করেছিলাম তাদের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকলেও ব্যক্তিগত কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। রাজনীতির মঞ্চে আমরা একে অন্যকে আদর্শ দিয়ে ঘায়েল করতাম। কিন্তু দিন শেষে একে অন্যের খোঁজ নিতাম। রাজনৈতিক বিভাজন থাকলেও সবার মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল। মনে আছে, ৯১ কি ৯২ সাল গোড়ান সোনালী ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গেছি। দীর্ঘ লাইন। আমার পেছনে থাকা একজন লোক আমাকে অতিক্রম করে টাকা জমা দিতে গেলেন। অনিয়ম হওয়ায় ক্যাশে থাকা ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে আমার তর্ক শুরু হল। আমার কয়েকজনের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তৎকালিন খিলগাঁও থানা বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা। তিনি আমাকে দেখিয়ে ব্যাংকারকে বললেন, একে চেনেন? সিরিয়ালে আগে এরটা নেবেন। পরে অন্যদেরটা। তার ওই ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।

আরেকটি ঘটনার কথা বলি, তখন আমি সবুজবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি। একটি ছেলে ছাত্রলীগে নতুন যোগ দিয়েছে। আমাদের ওই কর্মী ছাত্রদলের এক কর্মীর কিছু টাকা পেত। ওই টাকা না দেয়ায় একদিন সে তাকে মারতে যাচ্ছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ঘটনাস্থলে গেলাম। দেখলাম প্রচুর লোক ভিড় করে আছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তর্ক করার সময় আমি আমার ওই কর্মীকে বকাঝকা করলাম। ছাত্রদলের ওই ছেলের কাছে ক্ষমা চাওয়ালাম। পরে ছাত্রদল করা ওই ছেলে আমার কাছে ঋণ নেয়ার কথা স্বীকার করলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, দাদা আপনার কারণে আজ আমি অনেক বড় অপমানের হাত থেকে বেঁচে গেছি। আমি টাকাটা দিয়ে দেব। শাসনের মধ্য দিয়ে এমন অনেক ঘটনা সেই সময় আমরা মিটমাট করে দিয়েছি। আজ যখন দেখি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের মধ্যেই মারামারি দেখি তখন খুব খারাপ লাগে। টাকার বিনিময়ে ওরা ছাত্রলীগের কপালে যখন কলংকের তিলক এঁকে দেয় তখন অনেক কষ্ট পাই। আমি আশাবাদি মানুষ। দলের মুষ্টিমেয় কিছু ছেলের জন্য ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের সোনালী ঐতিহ্য নষ্ট হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের ভেতর যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন তাতে দল তার হারানো গৌরবে আবার ফিরবে বলে আশা করি।